জসীমউদ্দীন ইতি, ঠাকুরগাঁওঃ ঠাকুরগাঁওয়ের বিস্তৃর্ণ মাঠে আবাদ হচ্ছে ভুট্টা। এক সময় যেসব মাঠে গমের আবাদ হতো সেসব মাঠেই এখন আবাদ হচ্ছে ভুট্টা। স্থানীয় কৃষকদের মতে, গমের তুলনায় তিনগুণ বেশি ফলন হয় ভুট্টায়। ফলে এই অঞ্চলে গমের পরিবর্তে ভুট্টা চাষের দিকে মনযোগী হচ্ছেন কৃষকরা।
সরেজমিনে কয়েকটি এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, মাঠের পর মাঠ ভরে উঠেছে সবুজে। গাছে গাছে শোভা পাচ্ছে সাদা ফুল। ভুট্টার পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পর করছেন কৃষকরা।
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, গমের তুলনায় ভুট্টা চাষে বেশি লাভবান হচ্ছেন তারা। ফলে দিন দিন জেলায় ভুট্টার আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকে আগাম ও উচ্চ ফলনশীল জাতের ভুট্টা চাষ করেছেন। আবহাওয়া ভালো থাকলে এবং গত বছরের মতো দাম পেলে ভুট্টা চাষে এবছর অধিকহারে লাভবান হওয়ার আশা ও স্বপ্ন দেখছেন তারা।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গিলাবাড়ি গ্রামের কৃষক শাহিন ইকবাল ৬ বিঘা জমিতে ভুট্টা লাগিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের এখানে ভুট্টার গাছগুলো যথেষ্ট ভালো হয়েছে। এছাড়া ভুট্টার মোচাও এসেছে ভালো। আল্লাহ সহায় থাকলে এবার ভুট্টাতে কৃষকরা অধিক লাভবান হতে পারবো।
ভুট্টা চাষি বাকের আলী বলেন, গম ও আলুতে তেমন লাভ হয় না। তাই জেলার বেশিরভাগ কৃষক ভুট্টা চাষের দিকে ঝুঁকছেন। এক বিঘা জমিতে এবার ভুট্টা চাষ করতে সর্বোচ্চ খরচ হয় ৩০-৩৫ হাজার টাকা, পরিচর্যা অনুযায়ী ফলন পাওয়া যায় কমপক্ষে ৮০-১০০ মণ। এক বিঘা জমির ভুট্টা বিক্রিয় হয় কমপক্ষে ৮০-৯০ হাজার টাকা। অন্যদিকে এক বিঘা জমিতে গম হয় মাত্র ২০-২৫ হাজার টাকার। তাই গমের তুলনায় ভুট্টায় বেশি লাভ পাওয়ায় এর চাষ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পীরগঞ্জ উপজেলার মন্ডলপাড়া গ্রামের কৃষক হামিদুর রহমান বলেন, আমি গতবার ভুট্টা চাষ করেছিলাম ৩ বিঘা জমিতে। দাম ভালো পাওয়ায় এবার চাষ করেছি ৫ বিঘাতে। গাছের চেহারা খুবই ভালো আছে, তাতে আবহাওয়া ভালো থাকলে গতবারের তুলনায় এবার আরও বেশি ফলন হতে পারে।
রাণীশংকৈল উপজেলার কুমরগঞ্জ এলাকার কৃষক আব্দুল মান্নান বলেন, কৃষকরা ব্যাপকভাবে ভুট্টার আবাদ করেছেন। গত বছর আমি ৮০ কেজি ওজনের কাচা এক বস্তা ভুট্টা বিক্রি করেছি ২ হাজার ২০০ টাকায়। এবারও যদি এমন দাম থাকে তাহলে কৃষকরা ভুট্টাতে অনেক লাভবান হবে।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার হরিণমারি এলাকার কৃষক সমসের আলী বলেন, আলু করে শুধু লস হয়। দাম তেমন পাওয়া যায় না। গতবার ভুট্টার দাম ভালো ছিল। তাই আমিও এবার আগাম জাতের ভুট্টা চাষ করেছি।
হরিপুর উপজেলার কামাপুর গ্রামের কৃষক মনসুর আলী বলেন, গতবছর ভুট্টা চাষ করে লাভবান হওয়ায় কৃষকরা এবার বেশি করে চাষ করেছেন। যে আমাদের পরিবার থেকেই শুধু ১৫ বিঘা জমিতে চাষ করেছি ভুট্টা। আশা করছি এবার ভুট্টার দাম ভালো পাবো। কারণ যেহেতু বর্তমানে সবকিছুর দামে বেশি তাই আশা করি ভুট্টার দামও বেশি পাবো।
জেলায় মোট ১ লাখ ৫১ হাজার ৫৯৩ হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে চলতি মৌসুমে শুধু ভুট্টা চাষ হয়েছে প্রায় ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর চাষ হয়েছিল ৩৩ হাজার ৬০ হেক্টর জমিতে ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছিল ৩ লাখ ৬২ হাজার ৫৮১ মেট্রিক টন ভুট্টা। এক বছরের ব্যবধানে জেলায় ৫ হাজার হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে।
চলতি মৌসুমে গম চাষ হয়েছে ৩৬ হাজার ৬৫৭ হেক্টও জমিতে অথচ গতবছর চাষ হয়েছিল প্রায় ৪৫ হাজার হেক্টর। এক বছরে প্রায় ৯ হাজার হেক্টর জমিতে গমে আবাদ কমেছে। এছাড়াও গত মৌসুমে জেলায় আলু চাষ হয়েছিল ২৭ হাজার ৬৭৭ হেক্টর কিন্তু এবার তা কমে হয়েছে ২৬ হাজার ১৬৭ হেক্টর আবাদ হয়েছে বলে জানান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, গম ও আলুর চেয়ে ভুট্টার আবাদ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ ভুট্টার চাহিদা, বাজার মূল্য ভালো থাকায় এবং একই পরিমাণ জমিতে গমের তুলনায় ভুট্টার ফলন প্রায় তিন গুণ বেশি হওয়ায় কৃষকরা দিন দিন ভুট্টা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। আশা করছি চলতি মৌসুমে ১ হেক্টর জমিতে প্রায় সাড়ে ১১ টন করে জেলায় মোট ৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদ হবে। আমরা জেলা কৃষি বিভাগ কৃষকদের ভুট্টা চাষে সেচ, রাসায়নিক প্রয়োগসহ পোকা রোধের বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।